বিনোদন ডেস্ক:
কান চলচ্চিত্র উৎসবের ৭৭তম আসর শেষ দিনে (২৫ মে) এসে গেছে। আয়োজকরা যেন শেষের দিকের জন্য সেরা জিনিস জমিয়ে রেখেছিলেন! ইরানের মোহাম্মদ রাসুলফ পরিচালিত ‘দ্য সিড অব দ্য স্যাক্রেড ফিগ’ দেখে সেটাই মনে হচ্ছে অনেকের। পালে দে ফেস্টিভ্যাল ভবনের গ্র্যান্ড থিয়েটার লুমিয়েরে শুক্রবার (২৪ মে) বিকাল ৩টায় এর উদ্বোধনী প্রদর্শনী হয়েছে। এরপর দর্শকদের টানা ১২ মিনিটের অভিবাদন পেয়েছে (স্ট্যান্ডিং ওভেশন) ছবিটি। এবারের আসরে এটাই সবচেয়ে বেশি সময় ধরে করতালির রেকর্ড।
মোহাম্মদ রাসুলফের সামনের সারিতে বসেছিলেন মূল প্রতিযোগিতায় থাকা আরেক ছবি ‘দ্য অ্যাপ্রেন্টিস’-এর পরিচালক আলি আব্বাসি। ইরানি বংশোদ্ভূত এই ডেনিশ নির্মাতা দর্শকদের করতালি দিতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তখন একজন দর্শক ‘ফেম! ভি! লিবার্তে’ (নারী! জীবন! স্বাধীনতা!) লেখা কাগজ উঁচিয়ে ধরেন। মৌলিক অধিকারের জন্য বিক্ষোভ করা ইরানি নারীদের সঙ্গে একাত্মতার স্লোগান এটি।
দর্শকদের সাড়া ও রাজনৈতিক আবহের মিশেলে স্বর্ণপামের দৌড়ে এগিয়ে গেছে ‘দ্য সিড অব দ্য স্যাক্রেড ফিগ’। এর গল্প তেহরানের একটি পরিবারকে কেন্দ্র করে, যাদের মধ্যে ইরান সরকারের নিপীড়নমূলক কার্যক্রমের কারণে বিভক্তি দেখা দেয়।
কান উৎসবে নিজের চলচ্চিত্রের প্রদর্শনীতে অংশ নিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গত ১৩ মে ইরান থেকে ইউরোপে পালিয়ে আসেন মোহাম্মদ রাসুলফ। ইরান সরকারের সমালোচনা করে চলচ্চিত্র নির্মাণের কারণে তাকে আট বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে দেশটির আদালত। একইসঙ্গে কান থেকে ‘দ্য সিড অব দ্য স্যাক্রেড ফিগ’ প্রত্যাহার করে নিতে তাকে চাপ দিয়েছিল এবং ছবিটির প্রযোজক ও অভিনেতাদের হয়রানি করেছিল।
গ্র্যান্ড থিয়েটার লুমিয়েরের সামনে লালগালিচায় নিজের ছবির দুই অভিনয়শিল্পী সোহেলা গোলেস্তানি ও মিসাহ জারের স্থিরচিত্র দুই হাতে দেখিয়েছেন মোহাম্মদ রাসুলফ, যারা ইরান সরকারের কাছ থেকে কানে আসার অনুমতি পাননি। ছবিটির গল্প ইমানকে কেন্দ্র করে, যিনি তেহরানের বিপ্লবী আদালতের তদন্তকারী বিচারক। দেশব্যাপী রাজনৈতিক প্রতিবাদ তীব্র হওয়ার সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের অবিশ্বাস ও বিভ্রান্তি মোকাবিলা করতে হয় তাকে। এরমধ্যে তার বন্দুক রহস্যজনকভাবে অদৃশ্য হয়ে যায়। এতে আরও অভিনয় করেছেন মাহসা রোস্তামি ও সেতারে মালেকি।
কানে মোহাম্মদ রাসুলফ চেনা পরিচালক। ২০১১ সালে আ সাঁর্তে রিগা বিভাগে নির্বাচিত হয় তার ‘গুডবাই’। এর সুবাদে সেরা পরিচালক হন তিনি। একই বিভাগে ২০১৩ সালে দেখানো হয়েছে ‘ম্যানুস্ক্রিপ্টস ডোন্ট বার্ন’। ফিপরেসি পুরস্কার জিতেছে এটি। ২০১৭ সালে আঁ সার্তে রিগা বিভাগে সেরা চলচ্চিত্র হয়েছে ‘অ্যা ম্যান অব ইন্টেগ্রিটি’।
‘দ্য সিড অব দ্য স্যাক্রেড ফিগ’ প্রদর্শনের আগ পর্যন্ত স্বর্ণপামের জন্য বোদ্ধাদের কাছে সবচেয়ে ফেভারিট ছিল ফরাসি নির্মাতা জ্যাক অদিয়াঁরের স্প্যানিশ ভাষার সংগীত নির্ভর ছবি ‘এমিলিয়া পেরেস’। এতে অভিনয় করেছেন জোয়ি স্যালডানা, সেলেনা গোমেজ ও কার্লা সোফিয়া গ্যাসকোন।
ফরাসি সাংবাদিক জান-দ্যু ফেলিস মনে করেন, ‘এমিলিয়া পেরেস’ই জিততে পারে স্বর্ণপাম। তার যুক্তি, ‘সমকালীন প্রেক্ষাপটে ছবিটি সবার মন ছুঁয়েছে। এটি নিরীক্ষাধর্মী একটি কাজ।’
ছবিটি প্রসঙ্গে একই অভিমত জানিয়েছেন নাইজেরিয়ান সাংবাদিক অরিস আইগ্বোকায়েবোলো।
‘এমিলিয়া পেরেস’ জিতলে জ্যাক অদিয়াঁর ঢুকবেন দু’বার করে স্বর্ণপাম জয়ীদের অভিজাত ক্লাবে। এর আগে ৯ জন এই কীর্তি গড়েছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা। এবারের আসরে ‘মেগালোপলিস’ জিতলে হ্যাটট্রিক করবেন আমেরিকান এই নির্মাতা। যদিও বোদ্ধাদের মধ্যে ছবিটির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিভক্তি দেখা গেছে।
আমেরিকার আরও দুই পরিচালকের ছবি আছে মূল প্রতিযোগিতায়। এরমধ্যে শন বেকারের ‘আনোরা’র প্রতি মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন অনেকে। তাদেরই একজন আমেরিকান সাংবাদিক হোয়াই-চান বুই বলেন, ‘‘ছবিটি দেখে আমার দারুণ লেগেছে। আমি আরও কয়েকটি ছবি দেখেছি। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে চাই, এবারের আসরে ‘আনোরা’ই স্বর্ণপাম জেতার দাবিদার।’’
পল শ্রেডারের ‘ও কানাডা’ নিয়ে তেমন আগ্রহ দেখাননি কেউ। কানাডার ডেভিড ক্রোনেনবার্গ পরিচালিত ‘দ্য শ্রাউডস’ নিয়ে অত উচ্চাশা নেই কারও।
আলি আব্বাসির পরিচালনায় যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বায়োপিক ‘দ্য অ্যাপ্রেনটিস’, গ্রিসের ইয়োর্গোস লানতিমোসের ‘কাইন্ডস অব কাইন্ডনেস’, ইতালির পাওলো সরেন্তিনোর ‘পার্থেনোপ’, রাশিয়ার কিরিল সেরেব্রেনিকোভের ‘লিমোনোভ–দ্য ব্যালাড’, ব্রাজিলের করিম আইনুজ পরিচালিত ‘মোটেল ডেস্টিনো’, পর্তুগালের মিগেল গোমেজ পরিচালিত ‘গ্র্যান্ড ট্যুর’ ছবিগুলো নিয়ে অত আলোচনা নেই কানে।
তবে চমকে দিতে পারে ব্রিটিশ নারী নির্মাতা আন্ড্রেয়া আর্নল্ডের ‘বার্ড’ এবং সুইডেনের মান্নেস ফন হোর্ন পরিচালিত ‘দ্য গার্ল উইথ দ্য নিডেল’। দুটি ছবির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন অনেক বোদ্ধা।
এশিয়ার দুই প্রতিনিধি চীনের জিয়া জাং-কি পরিচালিত ‘কট বাই দ্য টাইডস’ ও ভারতের পায়েল কাপাডিয়ার ‘অল উই ইমাজিন অ্যাজ লাইট’ শক্ত অবস্থানেই আছে বলা যায়। কারণ দুটি ছবির প্রতিই নিজেদের ভালো লাগার কথা জানিয়েছেন অনেকে।
আমেরিকান সাংবাদিক লিওনার্দো গোই ‘অল উই ইমাজিন অ্যাজ লাইট’ ছবিটিকে এগিয়ে রাখলেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমার চোখে এই ছবিটিই সেরা। এটি দুর্দান্ত একটি ছবি। আমি আবারও এটি দেখতে চাই। বিচারকরা এই ছবিটিকে স্বীকৃতি না দিলে অবাকই হবো।’
ফ্রান্সের চারটি ছবি আছে মূল প্রতিযোগিতায়। এরমধ্যে সবচেয়ে ফেভারিট কোরালি ফারজাঁ পরিচালিত ‘দ্য সাবস্ট্যান্স’। এতে দারুণ অভিনয়ের জন্য ডেমি মুর সেরা অভিনেত্রী হয়ে যেতে পারেন বলে আশা করা হচ্ছে।
ফ্রান্সের জিল ল্যুলুশের ‘বিটিং হার্টস’, ক্রিস্তফ অনোরেঁ পরিচালিত ‘মার্সেলো মিয়ো’ এবং আগাত রিদাঁজের প্রথম চলচ্চিত্র ‘ওয়াইল্ড ডায়মন্ড’কে ফেলে দেওয়া যাবে না। মোদ্দা কথা, মূল প্রতিযোগিতায় থাকা যেকোনও ছবিরই স্বর্ণপাম জেতার সম্ভাবনা থাকে শেষ পর্যন্ত।
এবারের আসরে মূল প্রতিযোগিতা বিভাগে বিচারকদের প্রধান আমেরিকান পরিচালক-চিত্রনাট্যকার গ্রেটা গারউইগ। তার নেতৃত্বাধীন বিচারক প্যানেলে আছেন আমেরিকান অভিনেত্রী লিলি গ্ল্যাডস্টোন, ফরাসি অভিনেত্রী এভা গ্রিন, লেবানিজ পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার নাদিন লাবাকি, তুর্কি চিত্রনাট্যকার ও আলোকচিত্রী এব্রু জেলান, জাপানিজ পরিচালক হিরোকাজু কোরি-এদা, ইতালিয়ান অভিনেতা পিয়ারফ্রান্সেসকো ফাভিনো, স্প্যানিশ পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার হুয়ান আন্তোনিও বায়োনা, ফরাসি অভিনেতা-প্রযোজক ওমর সি। তারা কোন ছবিকে স্বর্ণপাম দেন সেটাই দেখার অপেক্ষা।