নিজস্ব প্রতিনিধি:
আগুন লাগলে বড় ধরনের ক্ষতি এবং যেকোনও সময় ধসে পড়ার শঙ্কা জানিয়ে ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটকে (দক্ষিণ) ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। ফায়ার সার্ভিসের তালিকায়ও এই মার্কেট ছিল অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু বিষয়টি আমলে না নিয়ে বছরের পর বছর ব্যবসা চালিয়ে আসছিলেন দোকানমালিকরা। গত বছরের (২০২৩ সাল) ১৫ এপ্রিল রোজার ঈদের কয়েক দিন আগে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় এই মার্কেট। প্রায় ৩৫০ কোটি টাকার মালামালসহ ২২৬টি দোকান পুড়ে যায়।
তদন্তের পর ফায়ার সার্ভিস জানায়, নিউ সুপার মার্কেটে নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয়েছিল। এছাড়া ছিল না নিয়মিত তদারকি। ফলে বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে এই অগ্নিকাণ্ড ঘটে।
ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে বারবার নোটিশ দেওয়ার পরও দোকান মালিক সমিতি সতর্ক ব্যবস্থা না নেওয়ায় কয়েক শ’ ব্যবসায়ী ক্ষতির মুখে পড়েন বলেও জানায় ফায়ার সার্ভিস।
সব হারিয়ে এখন টনক নড়েছে নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ীদের। ফায়ার সার্ভিসের সুপারিশ আমলে নিয়ে অগ্নিকাণ্ড ও দুর্যোগ মোকাবিলায় নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছেন তারা।
গত ১২ মে মার্কেট ঘুরে দেখা যায়, আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত মার্কেটটির প্রধান ফটকসহ অন্যান্য আসা-যাওয়ার পথ আগের মতো আর ছোট নেই। প্রতিটি পথ সম্প্রসারিত করা হয়েছে। আগের চেয়ে দোকানের সংখ্যাও কমিয়ে আনা হয়েছে।
পর্যাপ্ত আলো-বাতাস যেন ঢুকতে পারে, সে লক্ষ্যে মার্কেটের দক্ষিণ পাশে দুই-তিনটি দোকান পরপর ৮ ফুট করে মোট ১১টি জানালা রাখা হয়েছে। গভীর নলকূপের পানি সরবরাহের ব্যবস্থাসহ নতুনভাবে টেকসই বৈদ্যুতিক লাইন টানার কাজ চলমান রয়েছে।
মার্কেটের বর্তমান পরিবেশ নিয়ে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন ক্রেতা, দোকান-মালিক ও কর্মচারীরা। তারা বলছেন, মার্কেটটির কিছু অবকাঠামো নতুনভাবে নির্মাণ করায় পরিবেশ যেমন সুন্দর হয়েছে, তেমনই ব্যবসায়ীদের মাঝেও স্বস্তি ফিরে এসেছে।
মার্কেটের দ্বিতীয় তলার ব্যবসায়ী ‘হাজী পাঞ্জাবি পয়েন্টের’ ব্যবস্থাপক আব্দুর রহমান অগ্নিকাণ্ডে দোকানের সবকিছু হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন। পরে ১২ লাখ টাকা খরচ করে দোকানের সাজসজ্জা করান তিনি।
মার্কেটের বর্তমান পরিবেশ নিয়ে রহমান বলেন, আগের চেয়ে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। প্রবেশপথ বাড়ানোর জন্য কিছু দোকান কমিয়ে আনা হয়েছে। এখন আর আগের মতো গরম লাগে না। সব সময় ঠান্ডা থাকে। প্রচুর আলো-বাতাসও আছে। এই ব্যবস্থা যদি আরও আগে নেওয়া হতো, তাহলে আমরা এত ক্ষতিগ্রস্ত হতাম না।
তৃতীয় তলায় শার্ট-প্যান্টের দোকান ‘সিসিলি’র কর্মচারী মো. আলামিন বলেন, আগুন লাগার পর আমাদের রাস্তায় বসা ছাড়া কোনও পথ ছিল না। আমাদের কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। নতুন করে দোকান সাজাতে গিয়ে ১৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। সব হারিয়ে এখন আমরা সচেতন হয়েছি।
একই ফ্লোরে এআরবি ফ্যাশনের কর্মচারী মো. সাব্বির বলেন, এখন মার্কেটে প্রচুর আলো-বাতাস আসে। আগে দুপুরের দিকে গরমে মার্কেটে বসাই যেতো না। এখন ভালো লাগে। ক্রেতারাও মার্কেটে স্বাচ্ছন্দ্যে কেনাকাটা করতে পারছেন।
মার্কেটে আসা ক্রেতা রফিকুল ইসলাম বলেন, ঢাকার বড় মার্কেটগুলোর একটি হচ্ছে ঢাকা নিউ সুপার মার্কেট। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ কেনাকাটা করতে এখানে আসেন। আগের তুলনায় নিউ সুপার মার্কেটের পরিবেশ এখন অনেক ভালো। দ্বিতীয় তলার প্রবেশপথে ক্রেতাদের জন্য বসার জায়গা করা হয়েছে।
ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ী সমিতির প্রচার সম্পাদক আনিছুর রহমান রুনি বলেন, আমরা ফায়ার সার্ভিসের নীতিমালা মেনে মার্কেটের কিছু সংস্কার করেছি। টেকসই বৈদ্যুতিক লাইন বসানোর জন্য দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) থেকে ১ কোটি ৯৮ লাখ টাকা পাস হয়েছে। বিদ্যুতের সব ওয়্যারিং বদলানো হবে। এছাড়া তৃতীয় তলায় ৮ ফুট করে ১১টি জানালা তৈরি করা হয়েছে। মার্কেটের ভেতরে এখন পর্যাপ্ত আলো-বাতাস আসছে। নতুন করে মার্কেটে ৪৭টি অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র, গভীর নলকূপ ও ছাদে রিজার্ভ ট্যাংক বসানো হয়েছে।
অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে দোকান মালিক ও কর্মচারীদের কোনও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, মার্কেটের সিকিউরিটি গার্ড, সমিতির স্টাফদের ফায়ার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সবাইকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
এর আগে নিউ সুপার মার্কেটে আগুনের কারণ হিসেবে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক ও তদন্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী (অপারেশনস ও মেইনটেন্যান্স) বলেছিলেন, তদন্তে অনেক বিষয় নজরে রাখতে হয়। অনেক কারণ থাকে। বেশির ভাগ অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয় বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে। নিউ সুপার মার্কেটে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল, সেটা আমরা নিশ্চিত হয়েছি।
এ প্রসঙ্গে ফায়ার ও দুর্যোগ বিশেষজ্ঞ মেজর এ কে এম শাকিল নেওয়াজ বলেন, শুধু আলো-বাতাসের ব্যবস্থা করলেই হবে না, আগুন লাগার আড়াই থেকে তিন মিনিটের মধ্যে তা নেভানোর ব্যবস্থা রাখতে হবে। প্রথমত, সেখানে কতগুলো অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র রয়েছে, সেটি দেখতে হবে। যারা যন্ত্রগুলো ব্যবহার করবেন, তাদের আদৌও এ বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে কি না, সেটাও দেখার বিষয়। অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রের ব্যবহার জানতে হবে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো পানির সোর্স। শুধু দেখানোর জন্য করলে হবে না। প্রকৃত অর্থে কাজগুলো করতে হবে।