নিজস্ব প্রতিনিধি:
গত দুই বছর ধরে বিদেশি ফলের দাম অনেক বাড়তি। দাম বাড়তে থাকায় আপেল, মাল্টা ও কমলার মতো ফল খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন ক্রেতারা। এতে ধারাবাহিকভাবে ফল আমদানি কমেছে। দেশের মানুষ বিদেশি ফল খাওয়া কমিয়ে দিলেও এই বাবদ ক্রেতাদের খরচ বেড়েছে। ইতোমধ্যে আবারও বেড়েছে ফলের দাম। এখন ৩০০ টাকার কমে মিলছে না। যে কারণে চট্টগ্রামের ফলের দোকানগুলো অনেকটাই ক্রেতাশূন্য।
তিন কারণে বেড়েছে দাম:
ফল আমদানিকারকরা বলছেন, মূলত তিন কারণে বিদেশি এসব ফলের দাম বেড়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- আমদানি শুল্ক বৃদ্ধি, ডলার সংকট এবং ডলারের মূল্য বৃদ্ধি। এসব কারণে দাম বেড়েছে। সেইসঙ্গে বাজারে ক্রেতা কমেছে। অনেকে ফল খাওয়া কমিয়েছেন। পাশাপাশি ফল আমদানি কমেছে অন্তত ৫০ শতাংশ।
কমেছে আমদানি :
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিদেশি ফল আমদানি ১০ হাজার টন কমেছে। গত অর্থবছরে আমদানি হয়েছে ৫ লাখ ৮৯ হাজার টন। ফলভেদে খুচরা গড় মূল্য হিসাবে এসব ফল কিনতে ক্রেতাদের খরচ হয়েছে ন্যূনতম ১৬ হাজার কোটি টাকা।
আমদানি করা ফলের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিদেশ থেকে ৩৮ ধরনের ফল আমদানি করা হয়। এর মধ্যে আমদানির ৯৫ শতাংশই আপেল, মাল্টা, কমলা, আঙুর ও আনার। বাকি ৫ শতাংশ ফলের মধ্যে রয়েছে নাশপাতি, কিনুই, কতবেল, অ্যাভোকাডো, রাম্বুটান ও কিউই ইত্যাদি।
আমদানি খরচ বেশি:
বিদেশি ফলের দাম বাড়তে শুরু করে মূলত ২০২২ সালের জুন-জুলাই থেকে। ডলার-সংকটের কারণে আমদানি নিরুৎসাহিত করতে বিদেশি ফলের শুল্ক-কর বৃদ্ধি ও ডলারের বিনিময় মূল্য বেড়ে যাওয়ায় আমদানি খরচও বেড়ে যায়। এর বিপরীতে কমেছে চাহিদা। ২০২১-২২ অর্থবছরে বিদেশি ফল আমদানি হয় ৮ লাখ ২২ হাজার টন। সেখানে গত দুই অর্থবছরে আমদানি ২ লাখ ৩৩ হাজার টন বা ২৮ শতাংশ কমেছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় বাজারে ফলের দামও বেড়েছে। এতে চাহিদা কমে গেছে। কৃষিবিদরা বলছেন, দেশে এখন ফলের উৎপাদন বাড়ছে। বিদেশি অনেক ফলেরও আবাদ হচ্ছে। ফল আমদানিতে এর প্রভাব পড়েছে। অনেকে বিদেশি বাদ দিয়ে দেশি ফল দিয়ে চাহিদা মেটাচ্ছেন।
সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে:
রাউজান পাহাড়তলীর চৌমুহনী বাজারের খুচরা ফল বিক্রেতা নুরুল আবছার দেশবার্তাকে বলেন, ‘বিদেশি ফলের দাম এখন অনেক বেশি। যে কারনে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। আগে কেউ রোগী দেখতে কিংবা বেড়াতে গেলে স্বজনের জন্য ফল নিয়ে যেতেন। এখন দাম বেশি হওয়ায় ফল নেওয়ার পরিমাণ কমে গেছে। বর্তমানে খুচরায় প্রতি কেজি আঙুর ৪৫০, আপেল ২৮০-৩২০, মাল্টা ২৮০ এবং আনার বিক্রি হচ্ছে ৫০০ টাকায়। এই দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে।’
ক্রেতাদের খরচ বেড়েছে:
আমদানি খরচ ও শুল্ক-কর বৃদ্ধি দিন শেষে যুক্ত হয় পণ্যের দামে। আর পরিশোধ করতে হয় ক্রেতাদের। এর মধ্যে ক্রেতাদের সবচেয়ে বেশি খরচ হচ্ছে আপেল কেনায়। গত অর্থবছরে আপেল আমদানি করা হয়েছে ১ লাখ ৬৯ হাজার টন। প্রতি কেজি আপেলের গড় বিক্রয়মূল্য ছিল ২৮০ থেকে ৩২০ টাকা। এই হিসাবে আপেল কেনায় ক্রেতাদের খরচ হয়েছে ন্যূনতম ৪ হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা। একই সময়ে মাল্টা আমদানি হয়েছে ১ লাখ ৭৩ হাজার টন। এসব মাল্টার প্রতি কেজির গড় বিক্রয়মূল্য ছিল ২৪০-২৫০ টাকা। ২৪০ টাকা কেজি হিসাবে আমদানি করা মাল্টা কিনতে ভোক্তাদের খরচ হয়েছে ৪ হাজার ১৫৭ কোটি টাকা।
এনবিআরের হিসাবে, গত অর্থবছরে দেশে আঙুর আমদানি করা হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার টন। প্রতি কেজি আঙুরের গড় বিক্রয়মূল্য ছিল ৩০০ টাকা। তাতে আমদানি হওয়া ১ লাখ ২০ হাজার টন আঙুর কিনতে ক্রেতাদের খরচ হয় ৩ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা। একইভাবে আমদানি হওয়া ৬৯ হাজার টন কমলা কিনতে ক্রেতাদের খরচ হয়েছে (প্রতি কেজির গড় দাম ২৫০ টাকা) ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। একইভাবে আনারে ১ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা, নাসপাতি, কিনুইসহ অন্যান্য বিদেশি ফল কিনতে খরচ হয় ৭০০ কোটি টাকার বেশি। সবমিলিয়ে গত অর্থবছরে আমদানি হওয়া ফল কেনায় সব মিলিয়ে ক্রেতাদের খরচ হয়েছে ১৬ হাজার কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ফল আমদানি হয়েছিল ৫ লাখ ৯৯ হাজার টন। খুচরা বাজারে গড় বাজারদর হিসাবে ওই বছর আমদানি করা এসব ফল কিনতে ক্রেতারা খরচ করেছেন ন্যূনতম ১৪ হাজার কোটি টাকা।
চট্টগ্রাম ফল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. তৌহিদুল আলম দেশবার্তাকে বলেন, ‘দাম বৃদ্ধির কারণে বিদেশি ফল এখন সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। যে কারণে বিক্রিও অনেক কমেছে। চট্টগ্রাম ফলমন্ডিতে পাইকারিতে রবিবার আঙুর ৩৩০-৩৫০, মাল্টা ২৩০-২৬০, চীনা থেকে আমদানি করা আপেল ২২০-২৩০, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আসা আপেল ২৮০-৩০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।’
আমদানিকারকরা বলছেন, দেশে ডলার সংকট দেখা দেওয়ার পর ২০২২ সালের ২৩ মে বিদেশি ফল আমদানিতে ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপ করেছিল এনবিআর। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল ফল আমদানিতে ব্যাংক ঋণ সুবিধা। এখন নগদ টাকায় আমদানি করতে হয়। এ কারণে দাম বেড়ে গেছে।
আমদানি কমেছে ৫০ শতাংশের বেশি:
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম দেশবার্তাকে বলেন, ‘বিশেষ করে ডলার সংকট, ডলারের দাম বৃদ্ধি ও শুল্ক বৃদ্ধির কারণে বিদেশি ফলের দাম সাধারণ মানুষের নাগারের বাইরে চলে গেছে। বর্তমানে ফল আমদানি ৫০ শতাংশের বেশি কমেছে। আমরা ২০ কেজি ওজনের এক কার্টন আপেল বিক্রি করি চার হাজার টাকায়। এর মধ্যে দুই হাজার টাকা শুল্ক হিসেবে দিতে হয় কাস্টমসকে। ৭ কেজি প্যাকেটের আঙুর বিক্রি করছি দুই হাজার ২০০ থেকে দুই হাজার ৪০০ টাকায়। আনারে শুল্ক সবচেয়ে বেশি। কেজিতে ২০০ টাকা পর্যন্ত শুল্ক দিতে হয় আমাদের।’
আগের চেয়ে আমদানি কমার কথা স্বীকার করেছেন চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের উপপরিচালক ড. মোহাম্মদ শাহ আলম। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘বিদেশি ফল আমদানি আগের বছরের তুলনায় সম্প্রতি অনেক কমেছে। ডলার সংকট, শুল্ক বৃদ্ধিসহ নানা কারণে আমদানি কমেছে।
চলতি বছরের জুলাই মাসে ফল আমদানি হয়েছে ১৭ হাজার ৩৫৩ মেট্রিক টন উল্লেখ করে মোহাম্মদ শাহ আলম বলেন, ‘আগস্ট মাসে আমদানি হয়েছে ১৪ হাজার ৮৯৩ মেট্রিক টন। জুলাই মাসে আমদানি হওয়া ফলের মধ্যে আপেল ছয় হাজার ৬০০ মেট্রিক টন, কমলা ও মাল্টা ৭ হাজার ৯২৫ মেট্রিক টন, আঙুর দুই হাজার ৬৮০ মেট্রিক টন, নাশপাতি ১৪৮ মেট্রিক টন। আগস্ট মাসে আমদানি হওয়া ফলের মধ্যে রয়েছে আপেল ৬ হাজার ৪৫২ মেট্রিক টন, কমলা ও মাল্টা ৮ হাজার ৪৭ মেট্রিক টন, আঙুর দুই হাজার ৬৬৯ মেট্রিক টন এবং নাশপাতি ৪২৩ মেট্রিক টন।’
উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে বিদেশি ফল আমদানি হয়েছে ৫ লাখ ৬ হাজার মেট্রিক টন এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমদানি হয়েছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার মেট্রিক টন। চীন, থাইল্যান্ড, ভুটান, মিসর, ব্রাজিল, তিউনিসিয়া, পর্তুগাল, নিউজিল্যান্ড, আফগানিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ফ্রান্স থেকে বাংলাদেশে ফল আমদানি করা হয়।