ভ্রমণ ডেস্ক:
রেলে আমার প্রিয় পানীয় টম্যাটো জুস ও লেবু চা। এসি বা শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কামড়ায় হকারদের উঠতে দেয় কম। কিন্তু বরাত ভালো টম্যাটো জুস পাওয়া গেলো। সরসী দেবী বিস্কুট দেন। তাঁরাও জুস নেন। যদুনাথ বাবু ও সরসী দেবী আমাদের পূর্ব পরিচিত। কয়েকবার পরস্পরের বাড়ি যাওয়া-আসা হয়েছে। জুস পানের পর টিমের জয়েন্ট লিডার আমার ছেলে স্বাগত এসে রেলের ক্যান্টিনে রাতের খাবারের জন্য কী অর্ডার দেবে জানতে চাইলে সরসী বলল, অর্ডার দেওয়ার প্রয়োজন নেই। তিনি নয় জনের জন্য রুটি মাংস নিয়ে এসেছেন। তিনি স্বাগতকে বললেন, তোমাদের খাবার এখন বা পরে নিয়ে যেতে পারো।
স্বাগত চলে যাওয়ার পরেই টিকেট চেকার এলো। যদুনাথ বাবুর টিকেট চেক করে তাঁর দুই ছেলের অবস্থানের কথা তারা জানতে চাইল। যদুনাথ বাবু চেকারকে প্রকৃত পরিস্থিতি বোঝানোর চেষ্টা করলেন। চেকার আমাদের টিকেট ও পাসপোর্ট দেখে, বাংলাদেশে আমার পদমর্যাদার কথা শুনে একটু নিমগ্ন হলেন। তারপরও বললেন, এটা আইনসঙ্গত নয়। আমি বললাম, আমি আপনার সঙ্গে একমত। আমরা আমাদের সিটে চলে যাচ্ছি।
আমরা ওঠার ভঙ্গি করতেই চেকার মি. সেন বললেন, বসুন। সবাই যদি আপনাদের মতো ল’ এবাইডিং হতো দুই বঙ্গের হাল এমন বিশ্রী হতো না।
ভদ্রলোক আমার পাশে বসলেন। সরসী ভদ্রলোককে চা ও বিস্কুট দিলেন। সেন বাবু দুই বাংলার সাহিত্য সংস্কৃতি বিষয়ে প্রায় আধ ঘণ্টা আলোচনা করে এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি জানার আগ্রহ প্রকাশ করলেন। এক পর্যায়ে তিনি জানান যে, তাঁর পরিবারও শরণার্থী। বরিশাল শহরে বাড়ি ছিল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনারা এখানেই থাকুন। ডিউটি সেরে সময় পেলে আসবো।
আমি বললাম, অন্য চেকার এলে কী করবো? মি. সেন বললেন, ডিমোশনে যাঁদের মানসিক প্রস্তুতি রয়েছে, তাঁদের ভয় নেই, অবৈধ প্রমোশন চাইলে সমস্যা। আর কারও আসার কথা নয়। এলেও আমার কথা জানাবেন।’
যদুনাথ বাবু ধূমপায়ী। চার মিনার। ১৫-২০ মিনিট পরপর। আমিও ধূমপায়ী। বেনসন অ্যান্ড হেজেস। আমার বিলাসিতা শুধু ধূমপানে। হরিহর বাবু বলেন, পাকিস্তানের কিং স্টর্ক (বক সিগারেট) খুব কড়া, ভালো মানের সিগারেট ছিল। ছাত্রাবস্থায় ও রাজনীতি করার সময় আমার ব্র্যান্ডও কিং স্টর্ক ছিল। চার মিনারও কড়া সিগারেট। তবে পকিস্তানের মর্দান টোব্যাকোর কিং স্টর্কের জুড়ি নেই। অভিজাত শ্রেণির ধূমপায়ীদের জন্য উন্নতমানের ক্যাপস্টান, সিজারস, থ্রি ক্যাসলসও পশ্চিম পাকিস্তানে তৈরি হতো। পরে পূর্ব পাকিস্তানে এর শাখা প্রসারিত হয়। ধূমপায়ীদের জন্য রেলের এসি গাড়ি চড়া হারাম। গোটা কম্পার্টমেন্ট গন্ধে বা দুর্গন্ধে ভরে যায়। অধূমপায়ীদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়। ফলে ধূমপায়ীকে টয়লেটে নয়তো দুই কমার্টমেন্টের সংযোগস্থলের ক্ষুদ্র পরিসরে গিয়ে ‘মহৎ’ কর্মটি সারতে হয়। আমি চেষ্টা করতাম চেপে থাকতে।
যদুনাথ বাবু সলজ্জ মৃদু হেসে কিছুক্ষণ পরপর চটির আওয়াজ তুলে যাচ্ছেন আসছেন। সরসী ফোড়ন কেটে বললেন, তোমাকে নিয়ে স্লিপার কোচে গেলেই ভালো হতো।
রাত প্রায় দশটা। মিলি (সম্রাটের বৌ ) এসে তাদের খাবার ও জল নিয়ে গেল। আমরাও খাওয়া শেষ করলাম। আমার স্ত্রীর সঙ্গে সরসীর সখ্য ছিল। এবার তা আরও নিবিড় হচ্ছে মনে হলো। সরসীও যদুনাথ বাবুর মতো ননস্টপ বক্তা। তাঁর সকল অভিযোগ যদুনাথ বাবুর বিরুদ্ধে। যদুনাথ বাবু স্ত্রীর অভিযোগ হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেন, তুমি তো তোমার মহাদেবের এতো দোষ-ত্রুটির ফিরিস্তি দিলে, স্বাগতের মা তাঁর স্বামী সম্পর্কে একটা কথাও বললেন না।
কালিম্পঙ:
আমি বলি, যদুনাথ বাবু, আপনার স্ত্রী নিশ্চিত জানেন, আপনার কোনো গুণ না থাকলেও, কপালে আগুন। আমার চরিত্র এতো খারাপ যা জনসমক্ষে বললে আমার মান থাকে না, তাই তিনি স্পিকটি নট। সরসীসহ সকলে হাসাহাসি করে, দুই মহিলাকে নিচের দুই টায়ারে রেখে আমরা উপরে ডান ও বায়ের দুই টায়ারে উঠে পড়ি। যদুনাথ বাবু রাতে মনে হয় কয়েকবার উঠেছেন। ধূমপানের নেশা ছাড়াও ওনার শ্বাসের কষ্ট ও ব্লাড সুগার একটু বেশি। একবার দেখি সরসীর গায়ের ওপর কম্বল টেনে দিচ্ছেন। সকাল ৬টায় ঘুম ভাঙলেও পড়ে রইলাম।
৭টায় উঠতেই হলো। নিউ জলপাইগুড়ি ৯-১০টার মধ্যে পৌঁছাবে। সকালে বৌমা এলে মলিনা তাকে ব্যাগে রাখা অরেঞ্জ জ্যাম দিয়ে সকলকে চার পীস করে পাউরুটি দিতে বলল। সকালের খাবার খেতে খেতে সকাল প্রায় নয়টা। জানা গেলো ট্রেন জলপাইগুড়ি ঢুকছে। সকলে টয়লেট সেরে জিনিসপাতি বের করে পোশাক পরে তৈরি হয়ে গেলো। সাড়ে নয়টার দিকে এনজিপিতে পৌঁছি। স্টেশন দেখে হকচকিয়ে গেলাম। স্টেশন তো নয়, মনে হয় ছোট একটা গ্রাম।
নিউ জলপাইগুড়ি রেলওয়ে জংশন ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই স্টেশনে মিটার গেজ ও ব্রড গেজ গাড়ি চালানোর সংস্তুান রয়েছে। এটি নর্থ ঈস্ট ফ্রন্টিয়ার রেলওয়ে জোনের কাথিহার রেলওয়ে ডিভিশনের অন্তর্গত। শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি শহর ও উত্তর বঙ্গের মেট্রোপলিসের স্টেশনের মধ্যে এটি সবচেয়ে বড়। এর অন্যান্য স্টেশনগুলো হলো গুলমা, বাগডোগড়া, মাটিগাড়া, রাঙাপানি ও শিলিগুড়ি টাউন। ২০১৬ সালের জরিপ অনুযায়ী ভারতের সবচেয়ে ১০টি পরিচ্ছন্ন স্টেশন ও ১০০ বুকিং স্টেশনের মধ্যে এটি অন্যতম। জলপাইগুড়ি উত্তরবঙ্গ, সিকিম, নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ ও ভারতের সেভেন সিস্টার্স (আসাম, অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মিজোরাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়) প্রবেশদ্বার। এই স্টেশন ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে ভারতের উত্তর পূর্ব রাজ্যসমূহের সংযোগস্থল।
নেতারা আমাদের স্টেশনের বাইরে টেক্সি স্ট্যান্ডে বসিয়ে রেখে পাঁচজনেই উধাও। প্রায় ত্রিশ মিনিট পর দুটো জীপ নিয়ে হাজির। ওরা আমাদের এগ রোল খাইয়ে জীপে তুলল। আমরা লোলেগাঁওয়ের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
বনরক্ষকের আদি অফিস:
লোলেগাঁও হিমালয় পর্বতশৃঙ্গের একেবারে শেষে কালিম্পং জেলায় লেপচা উপজাতি অধ্যুষিত ছোট একটি গ্রাম। এই অঞ্চল নেওরাভেলী জাতীয় উদ্যানের অন্তর্গত। জলপাইগুড়ি থেকে কালিম্পং ও লাভা হয়ে ১২৪ কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান। লাভা মফস্বল শহর। নিরিবিলিতে নিসর্গের বুকে থাকা লোলেগাঁও থেকে এর দূরত্ব ৫০ কিলোমিটার। লাভারও চারপাশে শান্ত, স্নিগ্ধ শ্যামলিমা। লোলেগাঁও সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৬৭৫ মিটার উপরে অবস্থিত। লোলেগাঁও শব্দের অর্থ সুখী গ্রাম। জলপাইগুড়ি থেকে কালিম্পং হয়ে লোলেগাঁও ৪ ঘণ্টায় পৌঁছানো যায়। মোটামুটি মাঝারি মানের পিচ ঢালা পথ। মাঝে মাঝে ভাঙা। শরীরে ঝাঁকি লাগছিল। তবে পথের দুপাশে প্রকৃতির অকৃপণ শ্যামলী নিসর্গ আমাদের মন-প্রাণ বিবশ করে রেখেছিল। দুপাশের নিবিড় পাইন ও আলপাইন অরণ্য অতি সুদৃশ্য। ৪ ঘণ্টা কখন পার হয়ে গেল টেরই পেলাম না। পথ উঁচু-নিচু হলেও, আমরা কিন্তু উপরের দিকেই উঠছিলাম।
আমাদের বাহন সোজা বন বিভাগের রেস্ট হাউজে গিয়ে থামে। রেস্ট হাউজ বুক করা ছিল। ছেলেরা জীপ থেকে লটবহর নামিয়ে রেস্ট হাউজের সুদৃশ্য বারান্দায় রাখল। আমরাও বারান্দার আরাম কেদারায় গা এলিয়ে সামনের অনন্ত সবুজ অরণ্য ও দূরে পর্বতের পর পর্বত দেখে বিমোহিত হয়ে পড়ি। কেয়ার টেকার এসে জানাল জল তখনো গরম আছে। চাইলে স্নান করে নিতে পারি। আরো জানা গেল সেখানে বিদ্যুতের ব্যবস্থা নেই। সৌর প্যানেলে যে বিদ্যুৎ পাওয়া যায় তা দিয়ে জল গরম করা, বাল্ব জালানো হয়। রাত দশটায় সৌরবিদ্যুৎ বন্ধ। এরপর হ্যারিকেন বা মোম পোড়াতে হয়। হ্যারিকেন নেই, তবে মোম আছে। স্টোভে রান্না করা যায়। নেতারা হ্যারিকেনের জন্য কেরোসিনের ব্যবস্থা করেছে। প্রয়োজনে স্টোভে রান্না করা যাবে। রেস্ট হাউস কাঠের জতুগৃহ। তবে এই গৃহের কাঠ লাক্ষা দিয়ে নয়, পেরেক ঠুকে বানানো। ছাদ, মেঝে, দেয়াল, চেয়ার, খাট, আলমারি সবই কাঠের তৈরি। রেস্ট হাউজের এক পাশ তালাবন্ধ। ওটা বন কর্মকর্তাদের জন্য সংরক্ষিত। সম্প্রতি বন রক্ষক ও পরিদর্শকের জন্য আলাদা বিলাসবহুল রেস্ট হাউজ হয়েছে। বিদ্যুতের লাইন গেছে। নতুন নতুন সুদৃশ্য হোটেল, গেস্ট হাউজ হয়েছে। লোলেগাঁও এখন মফস্বল শহরের রূপ নিয়েছে। তবু নিবিড় শান্তি অক্ষয় আছে জানতে পেলাম। ঐতিহ্যবাহী প্রথম বন অফিসটি সংরক্ষিত রয়েছে।
বর্তমান রেস্ট হাউজ:
আমরা ফ্রেশ হয়ে খেতে বসলাম। সিম্পল খাওয়া। ভাত, ডাল, ডিমের ঝোল ও ভাজি। রাতে মুরগি হবে। সরসী ও যদুনাথ বাবু খেয়ে বিশ্রাম নিতে চলে গেলেন। আমি ছেলেদের নিয়ে বাইরে বসে তাস খেলছিলাম। সঙ্গে নিসর্গ দর্শন। লক্ষ করছিলাম কিছুক্ষণ পরপর প্রকৃতির রঙ পাল্টে যাচ্ছে। অস্তমিত সূর্যের হতবীর্যের আলোয় রাঙানো কালিম্পং যেনো প্রকৃতির ধূসর পাণ্ডুলিপি। এমন নিঃসীম নৈঃশব্দ্য আমার জীবনের প্রথম অভিজ্ঞতা।