সংবাদ শিরোনাম:

‘মাথা ন্যাড়া’ করে দেশ থেকে পালিয়েছেন মতিউর!

Facebook
LinkedIn
WhatsApp
Email
Print

নিজস্ব প্রতিনিধি:

ছাগলকাণ্ডে আলোচনায় আসার পর থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মতিউর রহমানের হদিস পাওয়া যাচ্ছিল না। তার বিভিন্ন বাসভবনে খোঁজ নিয়েও সন্ধান মেলেনি।
এমনকি কোরবানির ঈদের ছুটির পর অফিস খুললেও তিনি আর অফিসে আসেননি। এ সময়ে প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে তিনি দেশ ছাড়ার সব প্রস্তুতি সেরেছেন।
রোববার (২৩ জুন) বিকেলের দিকে আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে মতিউর পালিয়ে গেছেন বলে জানিয়েছেন তার ঘনিষ্ঠ একাধিক কাস্টমস কর্মকর্তা। এর আগে রোববার দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তার দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করতে তিন সদস্যের একটি টিম গঠন করেছে। একইদিনে কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের সভাপতি পদ থেকে সরিয়ে তাকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত (ওএসডি) করা হয়েছে। হারিয়েছেন তিনি সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পদও।
সব হারানোর পেছনে রয়েছে ‘ছাগলকাণ্ড’। ছেলে মুশফিকুর রহমান ইফাতের ১৫ লাখ টাকার ‘ছাগল কেনা’ ইস্যুতে তোপের মুখে পড়েন মতিউর। ইফাতের ছাগল কেনার বিষয়টি প্রথমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। এরপরই তা ‘টক অব দ্য কান্ট্রিতে’ পরিণত হয়।
শুধু তাই নয়, বেরিয়ে আসে এ কর্মকর্তা ও তার পরিবারের অঢেল সম্পদের চিত্র। মতিউরের ঘনিষ্ঠ কাস্টমস কর্মকর্তাদের কাছ থেকে জানা গেছে, আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে তিনি ভারতে পালিয়ে গেছেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী এরপর মতিউর রহমান ভারত থেকে সরাসরি দুবাইয়ের উদ্দেশে রওনা দিতে পারেন। প্রভাবশালী একটি সিন্ডিকেট তাকে দেশত্যাগে সহযোগিতা করেছে।
জানা গেছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অল্প সময়ে ভাইরাল হয়ে যাওয়ায় তিনি আতঙ্কে ছিলেন।
কারণ তার চেহারা সবার পরিচিত। তবে প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের পরামর্শে তিনি মাথা ন্যাড়া করে দেশ থেকে পালিয়ে যান। মূলত সবার কাছ থেকে চেহারা আড়াল করতে এ কৌশলের আশ্রয় নেন তিনি।
এর আগে ধানমন্ডি, কাকরাইল, গুলশানসহ মতিউরের পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের ঠিকানায় বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে কোথাও তাকে পাওয়া যায়নি। ঈদের ছুটি শেষ হওয়ার পর তাকে অফিস করতেও দেখা যায়নি। মূলত এরপর থেকেই দেশজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ‘মতিউর এখন কোথায়?’
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, ছাগলকাণ্ডের পর ছেলেকে অস্বীকার করে এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে গা ঢাকা দিয়েছিলেন। সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হয়ে নিজেকে আড়াল করে রেখেছিলেন তিনি। মোবাইল ফোনে যোগাযোগও ছিল সীমিত। সেই সময়ে অস্বীকার করা ছেলেকে নিরাপদে মালয়েশিয়ায় পাঠিয়ে দিয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছে একটি সূত্র।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিন্যান্স বিভাগে পড়াশোনা করা মতিউর রহমান অনেক কোম্পানির ছায়া পরিচালক। একাধিক ছোট কোম্পানি শেয়ারবাজারে আনার মাধ্যমে বাজার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে তিনি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। শেয়ারবাজার কারসাজিতে জড়িতদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে।
দুর্নীতি অনুসন্ধানে দুদকের টিম গঠন:
মতিউরের দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এজন্য সংস্থাটির উপপরিচালক আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি টিমও গঠন করা হয়েছে। রোববার দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন সাংবাদিকদের এসব তথ্য নিশ্চিত করেন।
তিনি বলেন, মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচারের অভিযোগ গত ৪ জুন কমিশন অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।
এর আগেও গত দুই যুগে চারবার মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এসব অভিযোগ পৃথকভাবে অনুসন্ধান করেছে দুদক। প্রতিবারই তিনি দুদক থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। তার বিরুদ্ধে করা অভিযোগের কোনো তথ্য-প্রমাণ পায়নি দুদক। এ প্রসঙ্গে দুদক সচিব বলেন, চারটি পুরোনো অভিযোগে অনুসন্ধান হয়েছিল। তবে এখন নতুন করে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তারা পুরোনো কী কী অভিযোগে তিনি রেহাই পেয়েছিলেন—সেসব বিষয়ও খতিয়ে দেখবেন।
এনবিআরের পদ হারালেন:
ছাগলকাণ্ডে সমালোচিত হওয়ার পর কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের সভাপতি পদ থেকে সরিয়ে তাকে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত (ওএসডি) করা হয়েছে। রোববার অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের উপসচিব মকিমা বেগম স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের সভাপতি মো. মতিউর রহমানকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করা হলো। এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে বলে জানানো হয়।
জানা গেছে, মতিউর রহমানের উত্থান মূলত ২০০৯ সালে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের যুগ্ম কমিশনার থাকাকালে। পরে গুরুত্বপূর্ণ একাধিক জায়গায় পদায়ন হয়েছে তার। এছাড়া দায়িত্ব পালন করেছেন বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ) ভ্যাটের কমিশনার হিসেবে। সেই সময় বিভিন্ন কোম্পানিতে ভ্যাট ডিমান্ড করে হয়রানির অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এমন একটি অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মতিউরের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের জন্য এনবিআর ও দুদককে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। তবে রহস্যজনক কারণে বিষয়টি নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি সংস্থা দুটি।
সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পদ থেকে অপসারণ:
সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পদে ছিলেন মতিউর রহমান। তবে ছাগলকাণ্ডে সমালোচিত হওয়ার পর সোনালী ব্যাংকের বোর্ড থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। রোববার পর্ষদ সভা শেষে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান ব্যাংকটির চেয়ারম্যান জিয়াউল হাসান সিদ্দিকী।
তিনি বলেন, ‘পরিচালক সরকারি পোস্ট। অর্থ মন্ত্রণালয় চিঠি ইস্যু না করলে চূড়ান্ত অপসারণ হবে না। তবে মন্ত্রণালয় আমাদের জানিয়েছে, তাকে সরানো হবে। আমাদের সোনালী ব্যাংকের বোর্ড থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। চূড়ান্ত অপসারণ মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি ইস্যুর পর। তবে এখন থেকে মতিউর রহমান সোনালী ব্যাংকের কোনো সভায় থাকতে পারবেন না। ’
নামে-বেনামে যত সম্পদধ:
মতিউর রহমান সরকারি চাকরি করে দুই স্ত্রী, পাঁচ সন্তান ও আত্মীয়-স্বজনের নামে গড়েছেন কয়েক হাজার কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ। এরই মধ্যে দেশেই প্রায় ৫০০ কোটি টাকার স্থাবর সম্পদের হদিস মিলেছে। ঢাকা, গাজীপুর, সাভার, নরসিংদী, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বাড়ি, জমি, ফ্ল্যাট-প্লট, রিসোর্ট রয়েছে। এছাড়া সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের নামে এফডিআর ও শেয়ারবাজারে নিজ নামে অর্ধশত কোটি টাকার বিনিয়োগ আছে। ছাগলকাণ্ডে আলোচিত পুত্রকেও কিনে দিয়েছিলেন প্রাডো, প্রিমিও ও ক্রাউনের মতো চারটি বিলাসবহুল গাড়ি। এসব গাড়ি তার বিভিন্ন কোম্পানির নামে রেজিস্ট্রেশন করা। কিনে দিয়েছেন দামি পাখিও। তার পরিচিত কাস্টমস কর্মকর্তারা বলছেন, বেনামে এনবিআর সদস্য মতিউর রহমানের হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকাতেই অন্তত দুই ডজন বিলাসবহুল ফ্ল্যাট রয়েছে মতিউর রহমানের স্ত্রী-সন্তান ও ঘনিষ্ঠদের নামে। সাহাবুদ্দিন পার্কের পাশে ৮৩ নম্বর রোডের ১১ নম্বর প্লটে আনোয়ার ল্যান্ডমার্কের বেগ পার্ক ভিউতে রয়েছে চারটি ফ্ল্যাট। সেখানেই প্রথম স্ত্রী নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার চেয়ারম্যান লায়লা কানিজকে নিয়ে সপরিবারে বাস করতেন। দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আখতার থাকেন লালমাটিয়ার ৮ নম্বর রোডের ৪১/২ ইম্পেরিয়াল ভবনে। কাকরাইলেও একটি ফ্ল্যাট রয়েছে ছোট স্ত্রীর নামে। এছাড়া ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে একাধিক ফ্ল্যাটের হদিস পাওয়া গেছে। বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ডেভেলপার কোম্পানি শান্তা ডেভেলপারের করা বিভিন্ন ভবনে তার আটটি ফ্ল্যাট রয়েছে বলে জানা গেছে। এসব ফ্ল্যাট প্রথম স্ত্রীর সন্তান ফারজানা রহমান ঈপ্সিতা ও ছেলে আহমেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণবের নামে কেনা হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আইনগত ঝামেলা এড়াতে নিজের স্ত্রী, সন্তান ও আত্মীয়-স্বজনের নামে সম্পদ গড়েছেন মতিউর রহমান। টঙ্গীতে ৪০ হাজার বর্গফুটের এসকে ট্রিমস নামের ব্যাগ ম্যানুফ্যাকচারিং ও অ্যাকসেসরিজ কারখানা রয়েছে তার। যদিও কাগজে-কলমে কারখানার মালিক তার ভাই এম এ কাইয়ুম হাওলাদার। ময়মনসিংহের ভালুকায় ৩০০ বিঘা জমিতে গ্লোবাল শুজ নামে দুটি জুতা তৈরির কারখানা রয়েছে। নরসিংদীর রায়পুরায় ওয়ান্ডার পার্ক অ্যান্ড ইকো রিসোর্ট রয়েছে। এসব রিসোর্টের মালিকানায় আছেন তার ছেলে ও মেয়ে। এছাড়া পূর্বাচলে আপন ভুবন পিকনিক অ্যান্ড শুটিং স্পটের মালিকও তিনি।
গাজীপুর সদর এলাকায় ১৭১ নম্বর এসএ দাগে ১০.৫০ শতাংশ, ১৭২ নম্বর এসএ দাগে ৩.৯০ শতাংশ, ১৬৩ নম্বর এসএ দাগে ৭.৫০ শতাংশ, ১৬৩ নম্বর এসএ দাগে ৬ শতাংশ, ১৭০ নম্বর এসএ দাগে ৬ শতাংশ, ১৬৩ নম্বর এসএ দাগে ৭ শতাংশ এবং ১৭০ নম্বর দাগে ৬ শতাংশ জমি রয়েছে। এছাড়া সাভার থানার বিলামালিয়া মৌজায় ১৩০৩৫, ১৭৬৩ ও ১৭৬২ নম্বর দাগে ১২.৫৮ শতাংশ জমির খোঁজ পাওয়া গেছে। এ আটটি খতিয়ানে রয়েছে তার ৬০ শতাংশ জমি। স্ত্রী লায়লা কানিজের নামে সাভার থানার বিলামালিয়া মৌজায় ১৩৬৯৬ নম্বর এসএ দাগে ১৪.০৩ শতাংশ, গাজীপুরে ৪৮.১৬ ও ১৪.৫০ শতাংশ এবং ছেলে আহমেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণব ও স্ত্রী লায়লা কানিজের নামে ০.৪৫১৬২৫ একর জমি রয়েছে।

Facebook
LinkedIn
WhatsApp
Email
Print

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *