সংবাদ শিরোনাম:

পাহাড়ে বেড়েছে বসতি, মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে সাড়ে ছয় হাজার পরিবারের বাস

Facebook
LinkedIn
WhatsApp
Email
Print

চট্টগ্রাম প্রতিনিধি:

টানা বৃষ্টিতে চট্টগ্রামে পাহাড়ধসের আশঙ্কার কথা জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। জেলা প্রশাসন ও সিটি করপোরেশনের লোকজন বারবার তাগাদা দেওয়ার পরও পাহাড়ের পাদদেশে ‘মৃত্যুঝুঁকি’ নিয়ে বসবাসকারীদের সরানো যায়নি। জেলা প্রশাসকের তালিকা অনুযায়ী, ২৬ পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারী পরিবার ছয় হাজার ৫৫৮টি। তবে এটি গত বছরের হিসাব। এবার জরিপ হয়নি। ফলে তাদের কাছে তথ্য নেই। তবে গত এক বছরের মধ্যে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতির সংখ্যা আরও বেড়েছে বলে জানালেন পরিবেশবিদ ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
বর্তমান পরিস্থিতি:
জেলা প্রশাসনের কার্যালয় সূত্র জানায়, বর্তমানে চট্টগ্রামে পাহাড় আছে ২৬টি। এর মধ্যে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও বিভাগের মালিকানাধীন ১৬টি। ব্যক্তিমালিকানাধীন ১০টি। এসব পাহাড়ে ছয় হাজার ৫৫৮টি পরিবারের বসবাস। তার মধ্যে সবাই মৃত্যুঝুঁকি মাথায় নিয়ে বসবাস করছে। ভারী বৃষ্টি হলেও তারা বসতি ছাড়ে না।
পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির তথ্য:
পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামের বিভিন্ন পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতির সংখ্যা গত ১০ বছরে বেড়েছে ১০ গুণ। আর তিন পার্বত্য জেলায়ও পাহাড়ে বসতি গত সাত বছরে হয়েছে দ্বিগুণ।
পাহাড়ের মালিকানা ও বসতির সংখ্যা:
২৬টি পাহাড়ের মধ্যে সাতটি রেলওয়ের (পূর্বাঞ্চল) মালিকানাধীন। এগুলোর মধ্যে পলিটেকনিক হল্ট স্টেশন সংলগ্ন পাহাড়ের পাদদেশে ১২, ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় ফৌজি ফ্লাওয়ার মিল সংলগ্ন পাহাড়ের পাদদেশে পাঁচ, ষোলশহর স্টেশন সংলগ্ন পাহাড়ের পাদদেশে ৭৪, ফয়’স লেক এলাকার ১, ২, ৩ নম্বর ঝিল সংলগ্ন পাহাড়ে চার হাজার ৪৭৬, মতিঝরনা ও বাটালি হিল সংলগ্ন পাহাড়ে ৪৩১, পরিবেশ অধিদফতর সংলগ্ন পাহাড়ে ৪৬ এবং লেকসিটি আবাসিক এলাকা সংলগ্ন বিজয় নগর পাহাড়ে ২৮৮টি পরিবার ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে।
গণপূর্ত বিভাগ-৩-এর মালিকানাধীন বাটালি হিল ও মতিঝরনা অংশের পাহাড়ে বাস করছে ৮৮ পরিবার। জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের মালিকানাধীন ফিরোজ শাহ হাউজিং এস্টেট সংলগ্ন পাহাড় ও কৈবল্যধাম হাউজিং এস্টেট সংলগ্ন পাহাড়ে বাস করছে যথাক্রমে ৪৯ ও ১৪৬ পরিবার। এ ছাড়া ১ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত তিন পাহাড়ের উত্তর পাহাড়তলী মৌজার ১৫০ দাগে (জয়ন্তিকা আবাসিক সংলগ্ন) ২৮, বিএস ২১২ ও ২১৩ দাগের পাহাড়ে (মুরগি ফার্ম হয়ে গার্ডেন ভিউ সোসাইটি সংলগ্ন) ১২ এবং আকবর শাহ বেলতলী পাহাড়ে ৮৯ পরিবার ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে। পাশাপাশি এপিভুক্ত (পরিত্যক্ত সম্পত্তি) পলিটেকনিক কলেজ সংলগ্ন পাহাড়ে ৪৩ এবং ভিপিভুক্ত (অর্পিত সম্পত্তি) লালখান বাজার জামেয়াতুল উলুম মাদ্রাসা সংলগ্ন পাহাড়ে ৩২৩ পরিবার বসবাস করছে।
বাকি ১০টি ব্যক্তি মালিকানাধীনের মধ্যে হারুন খানের পাহাড়ে ১৪৪, নাছিয়াঘোনা এলাকার পাহাড়ে ১২, চিড়িয়াখানার পেছনের পাহাড়ে ২৮, মধুশাহ পাহাড়ে ২৯, জালালাবাদ সংলগ্ন পাহাড়ে পাঁচ নাগিন পাহাড়ে ২৫, ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট সংলগ্ন মীর মোহাম্মদ হাসানের পাহাড়ে ৩৮, এমআর সিদ্দিকীর পাহাড়ে ৪২, মিয়ার পাহাড়ে ৪৯ এবং ভেড়া ফকিরের পাহাড়ে ১১ পরিবারের সদস্যরা বসবাস করছেন।
৩২ বছরে ১৮.৩৪৪ বর্গকিলোমিটার পাহাড় নিশ্চিহ্ন:
সম্প্রতি চট্টগ্রামে পাহাড় কাটা ও পাহাড়ধস নিয়ে সেমিনার করেছিল বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. কামাল হোসাইন। সেমিনারে বলা হয়, একসময় নগরীতে ছোট-বড় ২০০টি পাহাড় ছিল। ইতোমধ্যে ১২০টি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ১৯৭৬ সালে নগরের পাঁচটি থানা (বায়েজিদ, খুলশী, পাঁচলাইশ, কোতোয়ালি ও পাহাড়তলী) এলাকায় পাহাড় ছিল ৩২.৩৭ বর্গকিলোমিটার। ২০০৮ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ১৪.২ বর্গকিলোমিটার। গত ৩২ বছরে ১৮.৩৪৪ বর্গকিলোমিটার পাহাড় নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়েছে। যা মোট পাহাড়ের প্রায় ৫৭ শতাংশ।
পাহাড়ধসে মৃত্যুর পরিসংখ্যান:
জেলা প্রশাসনের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০৭ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১৭ বছরে চট্টগ্রামে পাহাড়ধসে ২৪৮ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এর মধ্যে ২০০৭ সালের ১১ জুন ভয়াবহ পাহাড়ধসে মারা যান ১২৭ জন। এর মধ্যে লালখানবাজার ওয়ার্ডের মতিঝরনা এলাকায় মারা যান ১১ জন। এ ছাড়া ২০০৮ সালে ১২, ২০১১ সালে ১৭, ২০১২ সালে ২৪, ২০১৩ সালে দুই, ২০১৫ সালে পাঁচ, ২০২২ সালে চার ও ২০২৩ সালে দুজনের মৃত্যু হয়।
ঝুঁকিপূর্ণ বসতিতে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির লাইন:
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগরীর ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে রীতিমতো বিদ্যুতের খুঁটি স্থাপন করে দেওয়া হয়েছে সংযোগ। কোথাও কোথাও রয়েছে গ্যাস ও পানির লাইন। পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রতিটি সভায় সেবা সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিরা এসব বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার ঘোষণা দিলেও বাস্তবে তা কার্যকর হয় না।
ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে বিদ্যুতের খুঁটি, গ্যাস ও পানির লাইন কীভাবে যাচ্ছে জানতে চাইলে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন মোহাম্মদ রেজা বলেন, ‘পরিবেশ অধিদফতর, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি এসব সংস্থাকে ম্যানেজ করে লাইন নেওয়া হয়েছে। এই চারটি সংস্থা কঠোর হলে অবৈধ দখলদারি বন্ধ হবে। এটি বন্ধ হলে ভূমিধসে ক্ষতি কমবে। পাহাড়ধসে প্রাণহানি বন্ধ হবে।’
লোকজনের মধ্যে ভয় কাজ করে না:
সর্বশেষ গত ২১ জুন সার্কিট হাউসে অনুষ্ঠিত হয় পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির ২৮তম সভা। সেখানেও বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সভায়ও কমিটির আহ্বায়ক বিভাগীয় কমিশনার মো. তোফায়েল ইসলাম ঝুঁকিপূর্ণ বসতি সরাতে কঠোর হওয়ার কথা বলেন। জানতে চাইলে তোফায়েল ইসলাম বলেন, ‘এতগুলো লোকের স্থায়ী পুনর্বাসন করা কঠিন। তারপরও সরকারি বিভিন্ন আশ্রয়ণ প্রকল্পে কিছু কিছু পুনর্বাসন করা হয়েছে। বৃষ্টি হলে আমরা পাহাড় থেকে লোকজনকে সরিয়ে নিচ্ছি। তবে লোকজনের মধ্যে ভয়টাও কাজ করে না।’
৩৬ সুপারিশের একটিও বাস্তবায়ন হয়নি:
২০০৭ সালের ১১ জুন ভয়াবহ পাহাড়ধসে ১২৭ জনের মৃত্যুর পর পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হয়েছিল। বিভাগীয় কমিশনারকে সভাপতি ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (রাজস্ব) সদস্যসচিব করে এ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিটির নাম দেওয়া হয়েছিল শক্তিশালী পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি। পরে কমিটির নাম থেকে শক্তিশালী শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। এই কমিটি ৩৬টি সুপারিশ দিয়েছিল।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল পাহাড়ে জরুরিভাবে বনায়ন, গাইডওয়াল নির্মাণ, নিষ্কাশন ড্রেন ও মজবুত সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ, পাহাড়ের পানি ও বালু অপসারণের ব্যবস্থা করা, বসতি-স্থাপনাসমূহ টেকসই করা, যত্রতত্র পাহাড় কাটা নিষিদ্ধ করা, পাহাড়ি এলাকার ১০ কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা নিষিদ্ধ করা, পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে হাউজিং প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে না দেওয়া, মতিঝরনা ও বাটালি হিলের পাদদেশে অবৈধ বস্তি উচ্ছেদ করে পর্যটন স্পট করা, ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের পাদদেশে বসতি স্থাপন নিষিদ্ধ করা এবং পাহাড় কাটায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা ইত্যাদি।
অথচ গত ১৭ বছরেও এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি। বরং প্রতি বছর বর্ষার আগে কিংবা পরে পাহাড়ধস হলেই টনক নড়ে সংশ্লিষ্টদের। পাহাড়ের পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে হাউজিং প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে না দেওয়ার সুপারিশ করা হলেও অনেকগুলো আবাসন প্রতিষ্ঠান পাহাড় কেটে গড়েছে হাউজিং প্রকল্প। এর মধ্যে এপিক, স্যানমারসহ বেশ কয়েকটি আবাসন প্রতিষ্ঠানকে জরিমানাও করেছে পরিবেশ অধিদফতর। এরপর থামানো যায়নি। এসব প্রতিষ্ঠান পাহাড় কেটে ভবন নির্মাণ করেই যাচ্ছে।
পাহাড় কেটে গড়ে উঠছে আবাসিক এলাকা:
পরিবেশবিদ প্রফেসর ড. ইদ্রিস আলী বলেন, ‘গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টি হলেও পাহাড়ধস হয়নি। এটা ভালো লক্ষণ। চট্টগ্রামে ১০০ মিলিমিটারের কম বৃষ্টিতেও পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে। প্রশাসনের সতর্কতার কারণে হয়তো ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের সরিয়ে নেওয়ায় মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। তবে পাহাড় কাটা বন্ধ হয়নি। সারা বছরই পাহাড় কাটা হচ্ছে। পাহাড় কেটে বায়েজিদসহ বেশ কিছু এলাকায় গড়ে উঠেছে আবাসিক এলাকা। সিডিএ এসব ভবনের অনুমতি দিয়ে যাচ্ছে। কীভাবে কোন যুক্তিতে সিডিএ পাহাড়ে, সরকারি খাল-নালার ওপর ভবনের অনুমতি দিয়ে যাচ্ছে, সে বিষয়ে কেউ কোনও কথা বলছেন না। যারা অনুমতি দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। যারা পাহাড় কেটে প্লট করছে তাদের জরিমানা করা হচ্ছে পাঁচ-ছয় লাখ টাকা। অথচ তারা এই প্লট বিক্রি করছে ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকা। পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা দিলেও তাদের আরও ৫৫ লাখ টাকা লাভ থাকে।’
সার্ভে হয় হয় না:
চট্টগ্রামে বর্তমানে কয়টি এবং কী পরিমাণ পাহাড় আছে, তা জানার জন্য সার্ভে করা প্রয়োজন উল্লেখ করে এই পরিবেশবিদ বলেন, ‘প্রতি বছর যদি সার্ভে হয়, তাহলে জানা যাবে কী পরিমাণ পাহাড় কাটা হয়েছে।’
আছে অনেকের প্রাণহানির শঙ্কা:
পাহাড়গুলোতে সাত হাজারের বেশি পরিবার বসবাস করছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক মো. আলীউর রহমান। তিনি বলেন, ‘এর মধ্যে ছয় শতাধিক পরিবার অধিকতর ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে। টানা বৃষ্টিতে যেকোনও সময় পাহাড়ধস হলে একসঙ্গে অনেকের প্রাণহানি ঘটবে। শুধু নগরী নয়, এর বাইরেও সীতাকুণ্ডের জঙ্গল সলিমপুরে তিন হাজারের বেশি পরিবার ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে। তাদের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া উচিত জেলা প্রশাসনের।’
যা বলছে জেলা প্রশাসন:
পাহাড়ে অবৈধ বসতি বন্ধে জেলা প্রশাসন কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জমান বলেন, ‘বসতি স্থাপনের খবর পেলেই উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়। এরপরও গোপনে বসতি বেড়েছে। পাহাড়-খেকোরা যতই শক্তিশালী হোক না কেন তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে। ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসকারীদের নিরাপত্তার স্বার্থে উচ্ছেদ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।’
আবহাওয়ার পূর্বাভাস:
চট্টগ্রাম পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ মো. আলী আকবর খান বলেন, ‘গত ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামে ৬৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। ৫ জুলাই পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হতে পারে। এরপর কমবে।’

Facebook
LinkedIn
WhatsApp
Email
Print

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *