সংবাদ শিরোনাম:

ধানমন্ডির কোনও ভবনে রেস্তোরাঁর অনুমতি নেই, অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি

Facebook
LinkedIn
WhatsApp
Email
Print

দেশবার্তা ডেস্ক:

ঢাকার বেইলি রোডে ‘গ্রিন কোজি কটেজ’ ভবনে ভয়াবহ আগুন ট্র্যাজেডির পর রাজধানীর ধানমন্ডিসহ বিভিন্ন এলাকার রেস্তোরাঁগুলোতে অভিযান চালায় সিটি করপোরেশন, রাজউক ও ফায়ার সার্ভিসসহ সংশ্লিষ্ট কয়েকটি সংস্থা। অভিযানে বেশিরভাগ রেস্তোরাঁ সাময়িক বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর মাসখানেকের মধ্যেই অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে সব রেস্তোরাঁ খুলে দেওয়া হয়। ঢাকার অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত ধানমন্ডির রেস্তোরাঁগুলোরও একই অবস্থা।
ধানমন্ডির প্রায় প্রতিটি সড়কেই গড়ে উঠেছে ক্যাফে ও রেস্তোরাঁ। বিশেষ করে সাত মসজিদ রোডের দুইপাশে বেশিরভাগ ভবনের প্রতিটি ফ্লোরে রয়েছে রেস্তোরাঁ। যদিও রাজউক থেকে এসব ভবনে রেস্তোরাঁ করার কোনও অনুমতি নেই। মূলত আবাসিক ও অফিস করার অনুমতি নিয়ে প্রায় অর্ধশতাধিক ভবনে অবৈধভাবে চলছে কয়েকশ’ রেস্তোরাঁ।
ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা যায়, ধানমন্ডির বেশিরভাগ রেস্তোরাঁর কোনও অনুমতি বা লাইসেন্স নেই। বিভিন্ন সংস্থার পরিচালিত অভিযানের পর এসব রেস্তোরাঁয় নামেমাত্র অগ্নিনিরাপত্তা সরঞ্জামের ব্যবস্থা নেওয়া হলেও আগুন নেভানোর জন্য তা যথেষ্ট নয়।
৩ জুন সরেজমিন দেখা গেছে, বেশিরভাগ রেস্তোরাঁয় নেই পর্যাপ্ত ফায়ার এক্সটিংগুইশার, বহির্গমন সিঁড়ি, সেন্ট্রাল পানির সংযোগ। এছাড়া রেস্তোরাঁয় কর্মরত স্টাফদের অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জাম ব্যবহারের দক্ষতাও নেই। কয়েকটি ভবনের বহির্গমন সিঁড়িতে রাখা হয়েছে এলপিজি সিলিন্ডার। তাপ তৈরি হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পানি ছিটানোর স্প্রিংকলার সিস্টেমও নেই কোনও রেস্তোরাঁয়।


আবাহনী মাঠের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে সাত মসজিদ রোডে অবস্থিত ছয়তলা ভবন মার্শাল প্লাজা। এর নিচতলায় স্টার কাবাব, এ ওয়ান কেক ও পেসটি শপ, বস সুইটস ও একটি লন্ড্রির দোকান রয়েছে। দোতলায় পিজা হাটে ওঠার নিজস্ব সিঁড়িটি একেবারেই সরু। একসঙ্গে দুজন ওঠা দায়। এ ছাড়াও পুরো ভবনেই রয়েছে খাবারের দোকান। এর মধ্যে অন্যতম ওল্ড টারেস, মোভেনপিক, ডোসা এক্সপ্রেস, পিজা বার্গ ক্যাফে, ওস্টারিও, দ্য ডাম্পলিং হাট। ভবনে একটি মাত্র লিফট ও একটি সিঁড়ি রয়েছে। ভবনের পেছনে একটি সরু স্টিলের সিঁড়ি থাকলেও সেটি কাস্টমারের জন্য নয়। দেখা গেছে, ছয়তলা পর্যন্ত ওই সিঁড়িটি এলপিজি সিলিন্ডার ও ময়লা-আবর্জনায় ভরা। সাম্প্রতিক অভিযানের পর এই ভবনের বেশিরভাগ রেস্তোরাঁয় নামমাত্র অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে রাজউক বা সিটি করপোরেশন থেকে রেস্তোরাঁ ব্যবসা চালানোর কোনও অনুমতি নেওয়া হয়নি। ক্যাফে ওস্টারিও-তে ফায়ার বল ও এক্সটিংগুইশার সিলিন্ডার ছাড়া আর কোনও অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জাম দেখা যায়নি। কিচেনের ভেতর দিয়ে জরুরি বহির্গমন সিঁড়ি থাকলেও সেটি ব্যবহারের অনুপযোগী। সিঁড়ির মুখে এবং বাইরে ময়লা-আবর্জনা পড়ে থাকতে দেখা যায়। এছাড়াও সিঁড়িতে গ্যাসের সিলিন্ডার রাখায় বিরাজ করছে ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি। একই অবস্থা দেখা গেছে প্রতিটি রেস্তোরাঁর বহির্গমন সিঁড়ি পথে।
জানতে চাইলে পিজা বার্গ রেস্তোরাঁর ম্যানেজার রাকিব হাসান বলেন, অগ্নিনির্বাপণের জন্য আমরা ফায়ার বল, অ্যালার্ম ও সিলিন্ডারের ব্যবস্থা করেছি। তবে ভবনের জরুরি সিঁড়ি যেটা আছে, সেটা ভবন মালিকের ব্যাপার। ফায়ার সার্ভিস ও সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়—এই ভবনে রেস্তোরাঁ করার কোনও অনুমতি নেই। তবু কীভাবে চলছে এসব রেস্তোরাঁ, এমন প্রশ্ন এখানে খেতে আসা মানুষদের।
বেইলি রোডে আগুনের ঘটনার পর ধানমন্ডির জিগাতলা মোড়ে কেয়ারি ক্রিসেন্ট টাওয়ারে অভিযান চালিয়ে ভবনটিকে অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স। আর সিটি করপোরেশন গত ৪ মার্চ ভবনটি সিলগালা করে দেয়। তবে এর ১৫ দিনের মাথায় সিটি করপোরেশনকে ম্যানেজ করে আবারও চালু করা হয় কেয়ারি ক্রিসেন্ট টাওয়ার। ১২ তলা এই ভবনের তিনটি ফ্লোর ছাড়া পুরোটাতেই চলছে রেস্তোরাঁ ব্যবসা। এর মধ্যে রয়েছে ক্রাশ স্টেশন, পার্ক অ্যান্ড স্নার্ক, সাভোরি গ্রিন ক্যাফে, ক্যাপিটাল লঞ্চ, প্লাটিনাম ক্লাব, স্বদেশী ও ক্যাফে গ্রাম্বলারসসহ ১০টি রেস্তোরাঁ। এসব রেস্তোরাঁর কোনোটিরই ফায়ার সার্ভিসের লাইসেন্স বা অনুমতি নেই। রেস্তোরাঁগুলোতে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র, ফায়ার বল ও সিলিন্ডার ছাড়া আর কোনও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। এই ভবনটিতে দুটি লিফট ও দুটি সিঁড়ি আছে। প্রতিটি ফ্লোরের সিঁড়ির সামনেই রয়েছে এক্সটিংগুইশার সিলিন্ডার। ক্রাশ স্টেশনের ম্যানেজার নাসিম আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ফায়ার নিরাপত্তার ব্যবস্থা জোরদার করা ভবন মালিক ও রেস্তোরাঁ মালিকের দেখার বিষয়। আমরা এখানে চাকরি করি। কয়েকদিন আগে পুলিশ এসে প্রতিটি রেস্টুরেন্টের স্টাফদের ধরে নিয়ে যায়। তারা ১০ দিন কারাভোগ করেছে। এখানে আমাদের দোষ কী!
সাত মসজিদ রোডের ‘রূপায়ণ জেড আর প্লাজা’। ১২ তলা এই ভবনে রয়েছে ১৩টি রেস্তোরাঁ। এগুলো হচ্ছে—ধানমন্ডি কাবাব অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট, বাফেট লাউঞ্জ, অ্যালাউস, দ্য বাফেট এম্পায়ার, মুম্বাই এক্সপ্রেস, দায়মাসু রেস্টুরেন্ট, ফ্যাসিনো, হান্ডি, লাভা রেস্টুরেন্ট, দ্য ডার্ক ক্যাফে অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট, বাফেট প্যারাডাইস, অ্যালাউস গোর্মেট ও সাকিব রেস্তোরাঁ।
ভবনে দুটি লিফট ও দুটি সিঁড়ি রয়েছে। তবে জরুরি বহির্গমন সিঁড়িটি পেছনের দিকে। প্রতিটি ফ্লোরে এই সিঁড়ির পাশেই রয়েছে বিভিন্ন রেস্তোরাঁর রান্নাঘর বা কিচেন। ফলে বহির্গমন সিঁড়িটি রেস্টুরেন্টে অতিথিদের ব্যবহারের উপযোগী নয়। প্রতিটি রেস্তোরাঁর সিঁড়ির জায়গাতে ময়লা-আবর্জনা রাখতে দেখা গেছে। কিচেনগুলোতে রয়েছে একাধিক এলপিজি সিলিন্ডার। ফলে, অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটলে মুহূর্তের মধ্যে আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা রয়েছে।
রূপায়ণ জেড আর প্লাজার ঠিক বিপরীত পাশে রয়েছে ইম্পেরিয়াল আমিন আহমেদ সেন্টার। এই ভবনে ১৫টি রেস্টুরেন্ট ও লাউঞ্জ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে— দ্য ফরেস্ট লাউঞ্জ, বাফেট এক্সপ্রেস, দ্য ক্যাফে রিও, অ্যামব্রোসিয়া ইনফিনিটি লাউঞ্জ, দ্য গ্রেট কাবাব ফ্যাক্টরি, দ্য বুফেট স্টোরিজ, গ্র্যান্ড লাউঞ্জ, ধাবা, গার্লিক ইন জিঞ্জার এবং হান্ডি। এ ছাড়া এই ভবনের নিচতলায় ইলেকট্রনিক্স সামগ্রীর শোরুম। কয়েকটি ফ্লোরে রয়েছে ফ্যাশন হাউজের শোরুমও। বেইলি রোডের আগুনের ঘটনার পর এ ভবনের বিদ্যুৎ, গ্যাস ও অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। গ্রাউন্ড ফ্লোর থেকে পাইপের মাধ্যমে ওপরের বিভিন্ন রেস্তোরাঁর কিচেনে এলপিজি গ্যাস নেওয়া হয়েছে। তবে বেশিরভাগ রেস্তোরাঁয় ফায়ার এক্সটিংগুইশার বল ও সিলিন্ডার থাকলেও অগ্নিনিরাপত্তার অন্যান্য ব্যবস্থা নেই।
সাত মসজিদ রোডে রেস্তোরাঁ ব্যবসার জন্য খ্যাত ভবনগুলোর মধ্যে অন্যতম কে বি (কেরামত আলী ভূইয়া) স্কয়ার। ১৩ তলা ভবনটিতে আছে ১৩টিরও বেশি রেস্তোরাঁ। ভবনের নিচতলা ও দোতলায় রয়েছে পোশাকের দোকান। নিচতলায় লিফট বা সিঁড়ি পর্যন্ত পৌঁছানোর প্যাসেজটির প্রস্থ বড়জোর আড়াই মিটার। গাদাগাদি করেই কাস্টমারদের ওঠানামা করতে হয়। লিফটের বাঁ-পাশেই জরুরি বহির্গমন সিঁড়ির দরজা। ভেতরে ঢুকতেই দেখা যায় সেখানে রাখা আছে একাধিক এলপিজি সিলিন্ডার। এছাড়াও সেখানে রয়েছে আরও দুটি রেস্তোরাঁর কিচেন। ফলে কোনও অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটলে মানুষের বের হওয়া সহজ হবে না। এই ভবনের প্রতিটি ফ্লোরেই রয়েছে ফায়ার এক্সটিংগুইশার, ফায়ার অ্যালার্ম ও বালতি ভরা বালি। তবে আগুন লাগলে এগুলো নিরাপত্তার জন্য যথেষ্ট নয় বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
রাজউক বলছে, কে বি প্লাজায় কোনও রেস্তোরাঁর অনুমতি নেই। গুহা রেস্টুরেন্টের মালিক রাহাতুল ইসলাম বলেন, ফায়ার সার্ভিসের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছি। ফায়ারের অনুমতিও নেওয়া আছে।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ (চলতি দায়িত্ব) মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে অগ্নিকাণ্ডের পর পুলিশ, রাজউক ও ফায়ার সার্ভিস যৌথভাবে বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় অভিযান চালায়। পরে রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির আবেদনের কারণে আন্তমন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে অভিযান স্থগিত করা হয়। রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি বলেছিল, দ্রুত তারা অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে এবং ঝুঁকিপূর্ণ রেস্তোরাঁর একটি তালিকা দেবে। তবে এখনও তারা সেটি দেয়নি।
রাজউকের এই কর্মকর্তা বলেন, ধানমন্ডির কোনও ভবনেই রেস্তোরাঁ পরিচালনার অনুমতি নেই। তবে কোনও আবাসিক বা বাণিজ্যিক ভবনের ১০ থেকে ১৫ শতাংশে রেস্তোরাঁ হতে পারে। এতে কোনও সমস্যা নেই। পুরো ভবনে রেস্তোরাঁ হলে ঝুঁকি বেড়ে যায়। এ ব্যাপারে রাজউক, সিটি করপোরেশন ও ফায়ার সার্ভিস মিলে আবারও অভিযানে যেতে পারে, বলেন এই কর্মকর্তা।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা (উপসচিব) কাইজার মোহাম্মাদ ফারাবী বলেন, ধানমন্ডি এলাকায় অভিযান চালানোর পর কয়েকটি রেস্তোরাঁ ও ভবন বন্ধ করা হয়েছিল। পরে তারা নিয়ম-নীতি অনুসরণ করে সেগুলো খুলেছে। তার দাবি, বেশিরভাগ রেস্তোরাঁয় অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। এটা পর্যাপ্ত কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিসের সমন্বয়ে তা খতিয়ে দেখা হবে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ঢাকাসহ সারা দেশে চার লাখের বেশি রেস্টুরেন্ট রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় আড়াই শতাধিক রেস্টুরেন্টের ফায়ার লাইসেন্স আছে। বেশিরভাগ ভবনে রেস্টুরেন্ট চালানোর পরিবেশ নেই। আমরা এগুলো পরিদর্শন করে কী কী ধরনের অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন, তার নির্দেশনা দিয়েছি। যদিও বেশিরভাগই সেই নির্দেশনা মানছে না। বিশেষ করে ভবন মালিকরা অগ্নিনিরাপত্তায় গুরুত্ব দিচ্ছেন না। এর ফলে রেস্টুরেন্টগুলোও জোরালো পদক্ষেপ নিচ্ছে না।’

Facebook
LinkedIn
WhatsApp
Email
Print

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *