সংবাদ শিরোনাম:

এনবিআরে মতিউরদের সংখ্যা কত?

Facebook
LinkedIn
WhatsApp
Email
Print

নিজস্ব প্রতিনিধি:

‘ছাগলকাণ্ডের’ মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে সরকারি চাকরি করে শত শত কোটি টাকার অবৈধ স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ অর্জনের অভিযোগ উঠেছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি ‘সম্পদের পাহাড়’ গড়েছেন বলে সংবাদ মাধ্যমে খবর বের হচ্ছে। এসব খবর সামনে আসায় তাকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সরানো হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের প‌রিচালনা পর্ষদ থেকেও।
মতিউরকে নিয়ে আলোচনা যখন তুঙ্গে তখন এনবিআরের প্রথম সচিব কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালের দুর্নীতির খবর সামনে আসে। দুজনের বিরুদ্ধেই ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ লেনদেনের মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রাথমিক অনুসন্ধানেই তাদের শত শত কোটি টাকার সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে।
প্রসঙ্গত, বরাবরই এনবিআরের কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে একাধিক গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়া ও ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ উঠে আসছে। ব্যবসায়ীরা নিয়মিতই ঘুষ না দিলে হয়রানি করা হয় বলে অভিযোগ করছেন। করদাতাদের বিভিন্ন কৌশলে হয়রানি করে তাদের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগও আছে।
যেসব অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়:
২০১৫ সালে নজিবুর রহমান ছিলেন এনবিআরের চেয়ারম্যান। ওই সময় ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি ছিলেন মাতলুব আহমাদ। তৎকালীন এনবিআর চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে একটি অনুষ্ঠানে মাতলুব আহমাদ বলেছিলেন, ১ টাকা কর দিতে গিয়ে ৩ টাকার হয়রানি হতে হয়।
২০১৫ সালের আগে ও পরে ব্যবসায়ী মহল থেকে এনবিআরের কর্মকর্তাদের দুর্নীতি নিয়ে কথাবার্তা হলেও ছাগলকাণ্ডের আগে এ বিষয়ে জোড়ালো কোনও পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।
গত ৯ জুন বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস) এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করে, ১০ টাকা ভ্যাট আদায়ের আড়ালে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে ৯০ টাকা ঘুষ দিতে হচ্ছে। এনবিআরকে এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানায় সংগঠনটি।
এর কয়েকদিন আগে গত ২৩ মে এক অনুষ্ঠানে সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, কর আদায়ের নামে হয়রানি করছে এনবিআর। হয়রানি বন্ধে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের পুরো প্রক্রিয়া অটোমেশন করার তাগিদ দেন তিনি।
চলতি বছরের জুনের শুরুতে অনুষ্ঠিত তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) এক সভায় কাস্টমসের অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে হয়রানির অভিযোগ তোলেন সংগঠনের সভাপতি এস এম মান্নান কচি। তিনি বলেন, কাস্টমসের অনেক কর্মকর্তা আমদানি-রফতানিকে বাধাগ্রস্ত করছে, উদ্যোক্তাদের হয়রানি করছে। এসব কর্মকর্তাদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।
এদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও কাস্টমসের হয়রানির বিষয়টি মন্ত্রিসভায় তোলা হবে বলে জানিয়েছেন পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক। চলতি বছরের ১৩ মে সচিবালয়ে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) প্রতিনিধিদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎকালে তিনি এ কথা বলেন।
এর আগে ২০১৮ সালে এনবিআরের অধীন কাস্টমস, এক্সাইজ অ্যান্ড ভ্যাট বিভাগে দুর্নীতির ১৯টি উৎস চিহ্নিত করে দুদক। ওই সময় দুদক টিম বলে, অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণে শিথিলতা দুর্নীতিকে উৎসাহিত করে। দুর্নীতি প্রতিরোধে ২৬ দফা সুপারিশ করে সংস্থাটি প্রতিবেদনটি তখন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়।
দুর্নীতিতে আগেও এসেছে অনেকের নাম:
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ঘুষ নেওয়ার দায়ে সহকারী কর কমিশনার অভিজিৎ কুমারকে চাকরি থেকে অপসারণ করেছে এনবিআর। তাকে ২০১৯ সালে ঘুষের ৫০ হাজার টাকাসহ গ্রেফতার করে দুদক।
গত ১১ জুন এনবিআরের বৃহৎ করদাতা ইউনিটের (এলটিইউ) সাবেক ভ্যাট কমিশনার ওয়াহিদা রহমান চৌধুরীর নামে মামলা দায়ের করেছে দুদক। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি অবৈধভাবে ৪ মোবাইল অপারেটরের ১৫২ কোটি টাকার ভ্যাট মওকুফ করেছেন। মামলার এজাহারের তথ্য অনুযায়ী গ্রামীণ ফোন, বাংলা লিংক, রবি ও এয়ারটেল অপারেটর কোম্পানির মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) মওকুফ করা হয়েছে। যার কারণে ১৫২ কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে সরকার।
এনবিআরের কাস্টমস বিভাগের সাবেক সহকারী কমিশনার মোখলেছুল রহমানের বিরুদ্ধেও দুদক অনুসন্ধান করছে। অচিরেই তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের পক্ষ থেকে চার্জশিট আদালতে দাখিল করা হতে পারে।
এর আগে ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে দুর্নীতির অভিযোগে এনবিআরের তিন কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়। তারা হলেন, সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মজিবুর রহমান সরকার, জি এম শাহজাহান ও রাজস্ব কর্মকর্তা গোলামুর রহমান। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে গুদাম থেকে স্বর্ণ সরানোয় জড়িত থাকার প্রমাণ মেলায় মজিবুর রহমান সরকারকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে।
জি এম শাহজাহান ২০০৮ সালে এক্সাইজ ও ভ্যাট ফেনী বিভাগীয় দফতরে কর্মরত থাকাকালে অবৈধভাবে ৬০ হাজার টাকা গ্রহণকালে দুদক হাতেনাতে ধরে ফেলে। পরে তল্লাশি করে আরও ৩১ হাজার ২০০ টাকা পাওয়া যায়। তার বিরুদ্ধে গৃহীত অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় বরখাস্ত করা হয়। একই অভিযোগে গোলামুর রহমানকেও বরখাস্ত করা হয়।
এছাড়া মাগুরায় ভুয়া মামলা দেখিয়ে ভিশন ড্রাগস লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে ১ কোটি টাকা ঘুষ দাবি এবং ২০ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে ভ্যাট অফিসের দুই রাজস্ব কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়। বেনাপোল কাস্টম হাউসে চাকরিরত অবস্থায় সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা খন্দকার মুকুল হোসেনকে প্রায় ২৩ লাখ টাকা পাচারকালে আটক করা হয়।
দুর্নীতির দায়ে ২০১৬ সালেও তিন কর্মকর্তাকে শাস্তি দেয় এনবিআর। ওই কর্মকর্তারা হলেন রংপুর কর কমিশনার অনিমেষ রায়, অতিরিক্ত কর কমিশনার মো. রিয়াজুল ইসলাম ও উপ-কর কমিশনার মোহাম্মদ আমিরুল করিম মুন্সী। ওই বছরে সর্বোচ্চ করদাতা মনোনয়নে দুর্নীতির অভিযোগে সহকারী কর কমিশনার সফি-উল-আলম নামে এক কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়।
এছাড়া দুর্নীতির অভিযোগে কাস্টমস কমিশনার এম হাফিজুর রহমান, সহকারী কর কমিশনার জাহিদুল ইসলাম, ঢাকা কর পরিদর্শন পরিদফতরের উপ-পরিচালক বিদ্যুৎ নারায়ণ সরকারসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
সমাধান কী:
কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও ব্যবস্থা গ্রহণ বিষয়ে অবস্থান জানতে এনবিআরের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র সাবেক সহ-সভাপতি, বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতিবাজদের বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছেন। আমরা এর বাস্তবায়ন দেখতে পাচ্ছি। আমরা দেখছি, বড় বড় পদে থাকা ব্যক্তিরাও দুর্নীতি করে পার পাচ্ছেন না। আমরা চাই এইসব দুর্নীতিবাজদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, মতিউরদের সংখ্যাই এনবিআরে বেশি। মতিউরদের মতো দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা কর্মচারীর সংখ্যা এখন ৯০ শতাংশের বেশি। তাদের ভয়েই মানুষ সরকারকে কর দিতে চায় না।
তিনি উল্লেখ করেন, এনবিআরে মতিউরদের দাপট কমাতে পারলে সরকারের রাজস্ব বাড়বে। যেহেতু মতিউরদের দাপট কমবে না, সেহেতু সিস্টেমে পরিবর্তন আনতে হবে। তার মতে, এনবিআরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারাও অবৈধ লেনদেনে অভ্যস্ত। তারা পেপারবেইজড সিস্টেম থেকে পুরোপুরি বের হতে চায় না। এজন্য তিনি অটোমেশন চালুর পরামর্শ দেন।

Facebook
LinkedIn
WhatsApp
Email
Print

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *