সংবাদ শিরোনাম:

আবারও রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালি টেরোরিস্ট’ ট্যাগ

Facebook
LinkedIn
WhatsApp
Email
Print

নিজস্ব প্রতিনিধি:

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য আবারও উত্তপ্ত। নতুন করে সহিংসতায় সেখানে বাস্তুচ্যুত হয়ে আরও ২ লাখ মানুষের মানবেতর জীবনযাপনের চিত্র এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে উঠে এসেছে। এমন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে আবারও আলোচনায় ‘বাঙালি টেরোরিস্ট’ শব্দযুগল। মিয়ানমারের জাতিগত সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি তাদের বক্তব্য, নথিপত্রে সীমান্ত এলাকা ও পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আবারও ‘বাঙালি টেরোরিস্ট’ বলে চিহ্নিত করছে। দেশটি থেকে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা অ্যাক্টিভিস্টরা বলছেন, ‘ডিজ-ওন’ করার লক্ষ্যেই তারা রোহিঙ্গাদের বরাবরই এই ট্যাগ দেওয়ার চেষ্টা করে। আর রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে যারা কাজ করেন তারা বলছেন, কাগজেপত্রে এই পরিচয় স্থায়ী হয়ে গেলে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় এর প্রভাব পড়তে পারে। রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ পরিচয়েই পরিচয় করাতে হবে। রাজনৈতিক লাভে নিত্য নতুন কোনও ট্যাগ দিতে দেওয়া ঠিক হবে না।
গত ফেব্রুয়ারি থেকে নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) সংঘর্ষ শুরু হয়। সেসময় জান্তা বাহিনীর দখলে থাকা সীমান্ত চৌকিগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেয় বিদ্রোহীরা। সীমান্ত চৌকিগুলোতে আরাকান আর্মির অভিযানের তীব্রতা বাড়তে শুরু করলে বাংলাদেশ পালিয়ে আসেন বিজিপি-র সদস্যরা। তারপর এরপর মংডু ও বুথিডাংয়ের দিকে অগ্রসর হয় আরাকান আর্মি। মে মাসে শুরুর দিকে রাখাইনের বুথিডাং শহরটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার কথা জানিয়েছে আরাকান আর্মি।
এই পুরো প্রক্রিয়ায় মাঠের যুদ্ধের পাশাপাশি আরাকান আর্মি ‘তথ্যগত যুদ্ধ’ও করে চলেছে। তারা মাইলের পর মাইল ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে অবলীলায় বক্তব্য দিয়েছে অন্যের ঘাড়ে দোষ দিয়ে। তাদের মতে, পরিস্থিতি খারাপের দিকে যেতে পারে এই শঙ্কায় সেখানকার বাসিন্দাদের শহর ছাড়তে সতর্ক করেছিল তারা। এমনকি আরাকান আর্মি অধ্যুষিত নিরাপদ জায়গায় তাদের সরিয়ে নিতে সহায়তাও করা হয়েছে। কেননা, এই পুরো হামলা অগ্নিসংযোগের জন্য দায়ী ‘বাঙালি টেরোরিস্টরা’।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দাবি করছে যে, রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মধ্যে থেকে ‘সন্ত্রাসীরা’ (যাদের তারা বাঙালি টেরোরিস্ট বলে) বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের জন্য দায়ী ছিল এবং যে কয়েক লাখ মানুষ পালিয়ে গিয়েছিল তারাই সেসব ঘটিয়েছিল। কারণ তাদের তা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
২০১৭ সালে রাখাইনে উত্তেজনার সময়েও যখন ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে, তখনও বলা হয়েছিল ‘বাঙালি সন্ত্রাসী’রা দায়ী। সম্প্রতি সিএনএন প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছেন, আরাকান আর্মি মুখপাত্র খাইং থু খা গত শুক্রবার সন্ধ্যায় টেলিগ্রামে লিখেছিলেন— বুথিডাংয়ের মুসলিম সম্প্রদায়গুলোকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে এবং শিশু, নারী এবং বয়স্ক ব্যক্তিসহ তাদের জন্য খাদ্য, আশ্রয় এবং চিকিৎসা সেবা প্রদান করছে। পরবর্তী সময়ে আরাকান আর্মির পক্ষ থেকে আবারও দাবি তুলে বিবৃতি দেওয়া হয় যে, তারা কখনোই বেসামরিক বস্তুকে লক্ষ্য করে না এবং অভিযোগের আঙুল তোলে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর দিকে। বুথিডাংয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর জন্য তারা সামরিক বাহিনীর মিত্র রোহিঙ্গা জঙ্গি গোষ্ঠীগুলিকে দায়ী করে– যাদের তারা ‘বাঙালি সন্ত্রাসী’ আখ্যায়িত করছে।
দীর্ঘদিন ক্যাম্পে কর্মরত বেসরকারি সংস্থার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শুরুর দিকে ২০১৭ সালের দিকে গণমাধ্যমে আরাকান আর্মি এই বাঙালি সন্ত্রাসী শব্দগুলো বলেছে, শুনেছি। এরপর অনেকদিন শুনিনি। কিন্তু কাজ করতে গিয়ে দেখেছি এই শব্দযুগল নিয়ে রোহিঙ্গা নেতারা বরাবরই তাদের শঙ্কার কথা বলেন। তাদের শঙ্কা, বাঙালি বলে তাদের ফেরানোর পথ বন্ধের চেষ্টা করছে আরাকান আর্মি।
ক্যাম্পে রোহিঙ্গা অধিকার নিয়ে কাজ করেন অ্যাক্টিভিস্ট অনিক (ছদ্মনাম) বলেন, আমরা গত মাসে দুয়েকবার খেয়াল করেছি বিষয়টা। গুরুত্বপূর্ণ কিছু কমেন্ট করতে গিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এই শব্দটাই ব্যবহার করে আরাকান আর্মি। এটা স্ট্যাবলিশ করার চেষ্টা আছে, সেটা বোঝা যায়।
রোহিঙ্গাদের কেন মিয়ানমার ‘বাঙালি সন্ত্রাসী’ বলেম এমন প্রশ্নে রোহিঙ্গা গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক রাহমান নাসির উদ্দিন বলেন, এটা মিয়ানমারের স্টেট ন্যারেটিভ। কারণ তারা রোহিঙ্গাদের ‘ইলিগ্যাল বেঙ্গলি মাইগ্র্যান্ট’ মনে করে বা রাষ্ট্রীয় তকমা দেয়। তাই, রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের তারা ‘বাঙালি সন্ত্রাসী’ বলে।
‘এটা আরেকটু আগে থেকে বুঝতে হলে বলতে হবেম আরাকান আর্মির সঙ্গে আরএসও’র (রোহিঙ্গা সলিডারিটি অরগানাইজেশন) দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। ২০১৭ সালের ঘটনার পর থেকে আরসা (আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি) বেশ কোনঠাসা। এই সুযোগে আরএসও মাঠে আসার চেষ্টা করে। ২০২১ সালের মিয়ানমারের সামরিক জান্তা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলে আরাকান আর্মি জান্তাবিরোধী সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করে। তখন জান্তা সরকার আরাকান আর্মির সঙ্গে আরসার সম্পৃক্ততা আছে বলে প্রকাশ্যে উভয়কে রাষ্ট্রবিরোধী হিসেবে দাবি করে। আরসার সঙ্গে সম্পৃক্ত রোহিঙ্গাদের জান্তা সরকার ‘বাঙালি সন্ত্রাসী’ বলে। অন্যদিকে আরএসও’র সঙ্গে সম্পৃক্ত রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালি সন্ত্রাসী’ বলে আরাকান আর্মি।
উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বলছে, বর্তমানে রাখাইনের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল। সংঘাত এখনও চলছে। আরাকান আর্মি জাতিগত রাখাইন জনগোষ্ঠীর জন্য স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে প্রায় সবকয়টি এলাকায় তারা তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে।

Facebook
LinkedIn
WhatsApp
Email
Print

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *